
রফিক মাহমুদ, উখিয়া (কক্সবাজার)
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতার আর পাহারা কেবল যেন নামেই। ক্যাম্পের ঘেরা-তারের ভেতর নেই নিয়ন্ত্রণ। প্রতিদিনই বেরিয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। কেউ পাহারার ফাঁক গলে, কেউবা কাঁটাতারের ছেঁড়া অংশ দিয়ে। এতে নিয়ন্ত্রণহীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাপ পড়ছে সড়কে গিয়ে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সড়কে সড়কে বসানো হয়েছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি চৌকি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে যানবাহন। শিক্ষার্থী, রোগী, কর্মজীবী যাত্রী—ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবাইকেই।
যদিও যানজটের কারণ শুধু নিয়ন্ত্রণহীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পই নয়। স্থানীয়দের মতে, সড়কের পাশে গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত বাজার, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও এই দুর্ভোগের জন্য সমানভাবে দায়ী।
এসব কারণে উখিয়া-টেকনাফ মহাসড়ক প্রতিদিনই পরিণত হচ্ছে ধীরগতির এক করিডোরে। সকাল হতেই শুরু হয় যানজট। কখনো লাইন ধরে গাড়ি আটকে থাকছে তল্লাশিতে, কখনো বাজারঘেঁষা অংশে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কর্মজীবীরা বলছেন, ‘দশ মিনিটের পথ পেরোতে দেড় ঘণ্টা লাগছে।’ কেউ কেউ ক্ষোভ ঝেড়েছেন—‘শুধু রোহিঙ্গা নয়, পুরো ব্যবস্থাটাই এলোমেলো।’
থাইংখালী এলাকার আব্দুল আলম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আড়াই ঘন্টা আগে পরীক্ষা দিতে বের হয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারছি না, কুতুপালং বাজারের কারণে’
কক্সবাজার থেকে প্রতিদিন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে হয় রোকেয়া জাহানের। তিনি চাকরি করেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। বলেন, ভোরে উঠে রওনা দিই কর্মস্থলের উদ্দেশে। সকালে যানজটের কবলে পড়ে সময়মতো পৌঁছাতে না পারার কারণে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আবার কাজ শেষে বিকালেও যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয়, ফলে বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়।
যৌথবাহিনীর উদ্যোগে মরাগাছতলা, বালুখালী ও কাস্টমস এলাকায় নিয়মিত তল্লাশি হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে শরণার্থী শিবিরে।
উখিয়ার অস্থায়ী সেনাক্যাম্পের সামনে রয়েছে তল্লাশিচৌকি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে স্ব স্ব ক্যাম্পে ফেরত পাঠাচ্ছে সেনাবাহিনী।
এমন একাধিক তল্লাশিচৌকিতে রোহিঙ্গা শনাক্তকরণের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই নিয়মিত যানবাহনের জটলা তৈরি হচ্ছে সড়কে। ফলে সাময়িকভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।
এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দ্রুত পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে একদিকে যেমন ক্যাম্পে কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনাকেও আধুনিক ও পরিকল্পিত করতে হবে।’
স্থানীয়দের মতে, মাদক ও অপরাধের হটস্পট হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত তল্লাশি অপরিহার্য। তবে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই তল্লাশিকে দ্রুত ও কার্যকর করা এখন সময়ের দাবিও বটে।
সড়কে নিয়মিত যানজট ও বিশৃঙ্খলার বিষয়ে জানতে চাইলে কোর্টবাজার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মিজানুর রহমান জানান, জনবল সংকটের কারণে সব জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ নিয়োজিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে কোর্টবাজার স্টেশন ছাড়া অন্য কোথাও ট্রাফিক পুলিশ শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নেই।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক পয়েন্টে নষ্ট কাঁটাতার ও অরক্ষিত অবস্থা নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ৮ এপিবিএন পুলিশের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ক্যাম্পের কাঁটাতার সংস্কারের কাজ তাদের অধীনে না থাকলেও, তল্লাশিচৌকিতে কঠোরতা এবং নজরদারি বাড়ানোর মাধ্যমে ক্যাম্পকে সুরক্ষিত রাখতে তারা বদ্ধপরিকর। তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পে সঠিক নিয়মে নজরদারি জোরদার করা হবে যাতে অবাধ বিচরণের সুযোগ কমানো যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, যানজট নিরসনে নিকটস্থ পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক পুলিশকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ট্রাফিক পুলিশের জনবল সংকট সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
পাঠকের মতামত